কম খরচে ঘুরে আসতে পারেন মেঘালয়ের শিলং, চেরাপুঞ্জি, ডাউকি থেকে ৫ দিনে – Complete Travel Guide Meghalaya
1 year ago bongcuriosity@gmail.com“পৃথিবীতে হয়তো দেখবার যোগ্য লোক পাওয়া যায়, তাকে দেখবার যোগ্য জায়গাটি পাওয়া যায় না..” শিলং পাহাড়ের উদ্যেশ্যে এমনই এক কালজয়ী উধৃতি শোনা যায় রবি ঠাকুরের উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’ এ।
বাঙালি শারীরিক ভাবে শিলং পাহাড়ে না গেলেও, রবি ঠাকুরের এই উপন্যাসে অমিত এবং লাবণ্যের হাত ধরে কবেই পাড়ি দিয়েছেন মেঘালয় রাজ্যের এই মনোরম স্থানটিতে। রবি ঠাকুরের লেখনী সঞ্চালনই যেন, বাঙালিকে শিলং পাহাড়ের প্রেমে ফেলতে বাধ্য করেছে। ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি তাই তাঁদের সফরনামায় শিলংকে রাখবেন না, এমন হতেই পারে না। কিন্তু যাঁরা এখনও এই মনোমুগ্ধকর জায়গাটি ভ্রমণ করে উঠতে পারেননি, আজ তাঁদের জন্যই রইল বিশেষ পর্ব। কীভাবে যাবেন, কী কী দেখবেন, কেমনই অর্থব্যয় করতে হবে, তার যথা সম্ভব সামগ্রিক আলোচনা করা হবে।
শিলং, পাহাড়ে ঘেরা একটি শান্ত, শৌখিন স্বর্গরাজ্য! প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড নামেও অভিহিত হয়ে থাকে কবিগুরুর অন্যতম প্রিয় স্থানটি। সরু আঁকা বাঁকা এবং ছিমছাম পাহাড়ি পথ যখন, এক টুকরো সূর্যের আলোর স্পর্শ পায়, তখন যেন শিলংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আরও মায়াবী হয়ে ওঠে। এই স্থান এমনই, যেখানে অতি বৃষ্টিও আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য হয়। তাই গ্রীষ্ম ছাড়াও শীত এবং বর্ষার সময়ও শিলং ভ্রমণ বিশেষ প্রাধান্য পেয়ে থাকে।
আকাশপথ, রেলপথ, এবং সড়ক পথেও আপনি শিলংয়ের উদ্যেশ্যে যাত্রা করতে পারেন।
আকাশপথে গেলে, আপনি শিলং বিমানবন্দরের সঙ্গে, আসামের রাজধানী গুয়াহাটির বিমানবন্দরও নির্বাচন করতে পারেন। গুয়াহাটি থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শিলং। তাই গুয়াহাটিতে অবতরণ করে, চারিদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কখন স্বপ্নের মত শিলংয়ের পাদদেশে এসে পৌঁছবেন, টেরও পাবেন না। কলকাতা থেকে গুয়াহাটির বিমান ভাড়া বিভিন্ন সময়েই পরিবর্তিত হয়ে থাকে, তবুও গড়ে মাথাপিছু,তিন থেকে চার হাজার মত টিকিটের মূল্য ধার্য হয়।
রেলওয়ে স্টেশনের ক্ষেত্রেও গুয়াহাটি স্টেশন হল অন্যতম প্রধান গন্তব্য। এটি হল প্রথম সম্পূর্ন সৌরচালিত রেলওয়ে স্টেশন। এখানে নেমে ক্যাব বা অন্যান্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সহায়তায় আপনি শুরু করতে পারেন আপনার যাত্রা।
মেঘালয়ের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান হল সদা বৃষ্টিস্নাত, চেরাপুঞ্জি। এই স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হয়ে উঠবে আপনার চোখ তথা মনের আরাম। এই অঞ্চলের মধ্যেই অবস্থিত এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম, মৌলিংনন। মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসিয়া জেলায় অবস্থিত এই গ্রামে গেলে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের আতিথেয়তা আপনার যাত্রাকে আরও শুভ করে তুলবে। এই গ্রামে যাওয়ার পথে পাহাড়ি রাস্তার বিভিন্ন বাঁকে পাবেন নাম না জানা নানা ঝর্নার সমাহার। জল কম থাকলেও, এই ঝর্না সংলগ্ন মনোরম পারিপার্শ্বিকতা আপনাকে ভালো থাকার ভরপুর অক্সিজেন জোগাবে বৈকি।
গ্রাম্য পরিবেশ হওয়ার দরুন, চেরাপুঞ্জিতে থাকার জন্য প্রচুর হোম স্টে পাবেন। যদিও আগে থেকে Agoda, make my trip, অথবা বুকিং.কম থেকে বুকিং করে যাওয়াতেই বিশেষ সুবিধা। এছাড়া থাকার সুবন্দোবস্তের জন্য হোটেলের দিক থেকেও কোনও ত্রুটি নেই এই অঞ্চলে।
হোটেল বা হোম স্টে উভয়ের ক্ষেত্রেই দুজনের জন্য খরচ হতে পারে দুই থেকে আড়াই হাজার মত। এই অঞ্চল সংলগ্ন ডাউকি বাজার থেকে চেরাপুঞ্জির বিভিন্ন জায়গায় পরিভ্রমণ করতে গাড়ি ভাড়া হিসেবে লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার।
চেরাপুঞ্জির পর অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে আপনার, সেভেন সিস্টার ফলস। চেরাপুঞ্জির মনমুগ্ধকর নৈসর্গিক বাতাবরণে এক রাত্রি কাটিয়ে, পরবর্তী দিন আপনি সেভেন সিস্টার ফলসের উদ্যেশ্যে যাত্রা করতে পারেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪৮৪ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এই জলপ্রপাতের সৌন্দর্য, বর্ষাকালে প্রকট ভাবে উপলব্ধ হয়ে থাকে। এই ফলস থেকে আপনার যাত্রাকে আরও রোমাঞ্চিত করে তোলার জন্য যেতে পারেন মোসামাই গুহা।
চেরাপুঞ্জির প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে করতেই, আপনার গাড়ি শিলংয়ের পথ ধরে ফেলবে। এবার আপনি চলতে থাকবেন সেই স্থান, যে স্থান হয়ে উঠেছে স্বয়ং রবি ঠাকুরের মানস-ভূমি! শিলং! শিলং যেতেও তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মত লাগবে আপনার পরিবহন ভাড়া। এখানেও আগে থেকে আপনার থাকার ব্যবস্থা করে গেলে, পৌঁছে আর হোটেল অনুসন্ধানের সমস্যা থাকবে না। শিলংয়ের বিখ্যাত পুলিশ বাজারের কাছে পাবেন অগণিত থাকার জায়গা। বলা যায় এটিই শিলংয়ের কেন্দ্রভূমি। পরদিন সকালে উঠেই একের পর এক সাইট সিয়িং এর উদ্যেশ্যে রওনা দিন। প্রথমে যেতে পারেন লাইট লুম। শিলং পুলিশ বাজার থেকে এখানকার দূরত্বে পৌঁছতে সময় লাগে ৪০-৪৫ মিনিট মত। নৈসর্গিক মুগ্ধতা কাকে বলে, তার জলজ্যান্ত সাক্ষ্য বহন করে এই স্থান। পাহাড়ের উপর জুড়ে রয়েছে সবুজের প্রলেপ, আর তাকেই স্পর্শ করে যায় ভাসমান মেঘের মেলা। এমন অপার্থিব দৃশ্য যেন আরও একবার আপনাকে বাধ্য করবে, শিলংয়ের প্রেমে ফেলতে।
লাইট লুম থেকে চলে যাবেন উমিয়াম লেক, এলিফ্যান্ট ফলস, শিলং ভিউ পয়েন্ট এবং লিভিং রুট ব্রিজে। তাছাড়া আপনার পথ নির্দেশক হিসেবে যেই চালক থাকবেন, তাঁর সঙ্গেও আলোচনা করে নিতে পারেন দর্শনীয় স্থান পরিভ্রমণের বিষয়ে। লাইট লুম যদি শুধু যেতে চান, তবে খরচ পড়তে পারে দেড় হাজার মত। সঙ্গে বাকি স্থানগুলিও দেখার জন্য খরচ হতে পারে আড়াই থেকে তিন হাজার।
পরেরদিন হাতে সময় নিয়ে, মেঘালয়ের অন্যতম স্বপ্নরাজ্য ডাওকির উদ্যেশ্যে গমন করুন। এক টুকরো স্বর্গ নেমে আসবে আপনার হাতের মুঠোয়। জয়ন্তী এবং খাসি পাহাড়ের মাঝের উমঙ্গোট নদী দেখলে মনে হয়, বিধাতা যেন মাটির উপর স্বচ্ছ কাঁচের গালিচা বিছিয়ে দিয়েছেন! যে কাঁচের স্বচ্ছতায় আকাশের প্রতিটি কনার প্রতিফলন থেকে, জলের নিচের এক অজানা জগতের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে! এমন স্বর্গীয় দৃশ্যের সাক্ষী হতে, শিলংয়ের সফরনামায় ডাওকি ভ্রমণ রাখতেই হবে। ডাওকি যাওয়ার জন্য পরিবহণ খরচ পড়বে তিন হাজার মত।
এছাড়াও খাওয়া দাওয়ার দিক দিয়েও শিলং বেশ শৌখিন। আমিষ, নিরামিষ সব রকমই পাওয়া যায় এই অঞ্চলে। শিলংয়ে যেমন বড় বড় রেস্তোরাও পাবেন, তেমনই সাধারণ বাঙালি খাবারের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। পুলিশ বাজার সংলগ্ন এলাকাতেই আপনি নির্বাচন করতে পারেন আপনার পছন্দসই খাদ্য তালিকা। সব মিলিয়ে, তিন অথবা চারদিনের শিলং ভ্রমণের জন্য আপনার খরচ হতে পারে দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা। তবে এই জায়গা ঘুরে এসেও যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্মৃতি আপনার মননভূমিকে দীর্ঘ সময় অবধি দখল করে রাখবে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই।