কলকাতার কিছু বিখ্যাত জায়গার নামকরণের ইতিহাস | History Some Famous Places in Kolkata
5 years ago bongcuriosity@gmail.comকলকাতা বাংলার রাজধানী। কলকাতা সম্পর্কে বেশির ভাগ মানুষেরই কিছু না কিছু ইমোশন রয়েছে। তাই কলকাতার বিভিন্ন জায়গার নাম আপনারা তো সবাই জানেন যেমন বাগবাজার, শোভাবাজার, শ্যামবাজার, হাতিবাগান, সোনাগাছি, কুমোরটুলি এবং উল্টোডাঙ্গা ইত্যাদি কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছেন কি এই নামগুলি কোথা থেকে এলো হঠাৎ করে এইরকম নামগুলি কেন দেয়া হলো। তাহলে চলুন আজ আমরা কিছু পুরনো ইতিহাস খুঁজে দেখি।
• কুমোরটুলি
শোভাবাজার রাজবাড়ির কথা আমরা সবাই জানি। এই রাজবাড়ীতে দুর্গা প্রতিমা তৈরি করার জন্য কৃষ্ণনগর থেকে কিছু কুমোর এনে এখানে রাখা হয় এবং তাদেরকে শোভাবাজার রাজবাড়ির আশেপাশে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সেই জায়গাটি বর্তমানে কুমোরটুলি নামে পরিচিত হয়।
• সোনাগাছি
কলকাতার মধ্যে সোনাগাছি হলো একটি জনপ্রিয় জায়গা এটি রাতপরীদের এলাকা অর্থাৎ নিষিদ্ধপল্লী নামে পারিচিত। সোনাগাছি এই নামটি আসে সোনাউল্লাহ গাজী নামক এক পীরবাবার নামানুসারে।
এর পাশাপাশি আরও একটি জায়গা ছিল যাকে রূপোগাছি বলা হত। এখানে যাওয়া মানুষদের আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে এই দুটি নামকরণ করা হয়েছিল
• হাতিবাগান
এই অদ্ভুত নামটির পিছনে দু’ধরনের ইতিহাস রয়েছে বলা হয় নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৬ সালে কলকাতা আক্রমণ করার সময় তার হাতিগুলোকে এখানে রেখেছিলেন তাই থেকে এর নাম হয় হাতিবাগান আবার অনেকের মতে এখানে কোন এক প্রভাবশালী ব্যক্তি বসবাস করতেন তার উপাধি ছিল হাতি এবং তার প্রাসাদে ছিল একটি বিশাল বাগান যেখান থেকে এই জায়গার নাম হয় হাতিবাগান।
• বউবাজার
বউবাজার নামটির উৎপত্তি নিয়ে দু’ধরনের মতবাদ রয়েছে অনেকে বলেন এই অঞ্চলে বহু বাজার ছিল এবং সেখানে বহু জিনিসপত্র বিক্রি হতো তা থেকেই এটিকে বহুবার বলা হতো।
আবার অনেকের মতে তৎকালীন বিখ্যাত বিশ্বনাথ মতিলাল এই অঞ্চলের বাজারটি তার বাঙালি পুত্রবধূকে লিখে দেন। পুত্রবধূকে হিন্দিতে যেহেতু বহু বলা হয় তাই তা থেকেই এই বাজারের নাম হয় বহু বাজার।
উভয় ক্ষেত্রেই বহুবাজার কথাটির অপভ্রংশ ঘটে নাম হয় বউবাজার।
ডালহৌসি স্কোয়ার য়া বর্তমানের বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত রাস্তা দিয়ে বলা হতো বউবাজার স্ট্রীট পরে স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী নামানুসারে এই বউবাজার স্ট্রিটের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট কিন্তু জায়গাটির নাম বউবাজার ই থেকে যায়।
• ঠনঠনিয়া
অনেকের মতে ওই এলাকাটি কয়েকটি বাড়িতে লোহার কাজ হতো।সেখান থেকে দিনরাত ঠন ঠন শব্দ আসতো। সেই লোহা পেটানোর শব্দের থেকেই নাম ঠনঠনিয়া। আবার অনেকে বলেন, বহু পূর্বে ওই এলাকায় ডাকাতের উৎপাত ছিলো। ডাকাত আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিলে, পল্লীবাসী বৃন্দকে সজাগ করতে ঠন ঠন করে মন্দিরের ঘন্টা বাজানো হতো, সেই থেকেই নাম ঠনঠনিয়া।
• চিৎপুর
এখন যেখানে স্ট্যান্ড রোড, সেখান দিয়েই বইত হুগলি নদী। তখনও শহর ঠিক মতো গড়ে ওঠেনি জঙ্গলাকীর্ণ ওই অঞ্চলে ছিল চিতু ডাকাতের আধিপত্য। আনেকের মতে ভাগীরথী-হুগলী নদীতে ভেসে আসা একটি নিম গাছের গুঁড়ি দিয়ে জয়চন্ডী চিত্তেশ্বরী দুর্গা মুর্তি তৈরী করেন চিতে ডাকাত।
পরবর্তীকালে মনোহর ঘোষ নামে এক ব্যক্তি চিত্তেশ্বরী দুর্গার মন্দির তৈরি করেন। এই চিত্তেশ্বরী দুর্গার নামানুসারেই এখানকার নামকরন হয় চিৎপুর।
• শ্যামবাজার
এই নামটি নিয়েও রয়েছে দু’ধরনের মতবাদ বিখ্যাত ঐতিহাসিক গৌরদাস বসাক এর মতে তখনকার (অষ্টাদশ শতাব্দীর)ক্যালকাটার একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ছিলেন শোভারাম বসাক এবং তাঁর গৃহদেবতা শ্যামরায়ের (কৃষ্ণ) নামানুসারে এই অঞ্চলের বর্তমান নামকরণটি করেন।আবার আনেকের মতে তার বাড়ির পুকুরের নাম শ্যামপুকুর থেকে শ্যামবাজার নামটি এসেছে। অন্যদিকে কলকাতা বিশেষজ্ঞ প্রাণ কৃষ্ণ দত্তের মতে এই পুকুরটি ছিল প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ শ্যামচরণ মুখোপাধ্যায়ের।
• বাগবাজার
বাগবাজার জায়গাটি প্রাচীন সন্দেহ নেই কিন্তু সমস্যা নামকরণের উৎস নিয়ে। কেউ কেউ মনে করেন, ফার্সি শব্দ ‘বাগ’ অর্থাৎ বাগান এবং আরবি শব্দ ‘বাজার’ অর্থাৎ জিনিসপত্র বিক্রির জায়গা মিলেমিশে ‘বাগবাজার’ নামটি এসেছে।
আবার অনেকের মতে বাগবাজার কথার অর্থ হল ফুলের বাগান, তাই ধারণা করা হয় এই জায়গায় প্রচুর ফুলের বাগান ছিল বা ফুলের বাজার বশত সেই থেকে এই নামটি এসেছে।
• বড়বাজার
বড়বাজার নামটি শুনে হয়তো আপনার মনে হতে পারে যে নামটি বাজারের আকার সাথে সম্পর্কিত কিন্তু না প্রকৃতপক্ষে বাজারটির নাম রাখা হয়েছিল বুড়ো হিন্দুদের দেবতা শিবের একটি জনপ্রিয় নামের ভিত্তিতে কিন্তু পূর্বেকার কিছু হিন্দিভাষী ব্যবসায়ীদের দারা বড়া নামটি প্রচলিত হয়ে যায় যা থেকেই বড়াবাজারা বা বড়বাজার নামটি এসেছ্র।
• লালবাজার
লালবাজার পুলিশ বাহিনীর হেডকোয়ার্টার ব্রিটিশ আমলে এই জায়গাটি ছিল পুলিশ বাহিনীর সবচেয়ে বেশি আনাগোনা তবে তার সাথে লালবাজার নাম কি সম্পর্ক সম্পর্ক, সম্পর্ক আছে ব্রিটিশ পুলিশরা মাথায় লাল টুপি ব্যবহার করত সেখান থেকেই জায়গাটির নাম হয় লালবাজার।
• লালদিঘি
কলকাতা বিশেষজ্ঞ প্রাণ কৃষ্ণ দত্তের মতে গোবিন্দপুরের মুকুন্দরাম শেঠ বা তাঁর পুত্রেরা এই দিঘি খনন করিয়ে ছিলেন। এই দিঘির ধারে তাঁর কাছারি ছিল। দোলের দিন দীঘির জল পুরো লাল হয়ে যেত রং খেলার জন্য তাই দিঘির নামকরণ হয় লালদিঘি।
আবার অনেকে বলে দিঘির পাশে একটি লাল রং এর বাড়ি(ওল্ড মিশন চার্চ) ছিল তার প্রতিবিম্ব দীঘির জলে পড়তো বলে দিঘিটি লালদিঘি নামে পরিচিত হয়।
• বরাহনগর
অনেকে বলেন বরাহনগর চারিদিকে শূকরের উৎপাত ছিল সেই থেকেই বরাহনগর নাম।
• উল্টোডাঙ্গা
এখানে খালের পাশে নৌকা বা ডিঙি উল্টো করে আলকাতরা লাগানো হত। তার থেকে উল্টোডিঙি অপভ্রংশ উল্টোডাঙ্গা।
• কলকাতা
কলকাতার কথা না বললেই পুরো বিষয়টি অসম্পূর্ণ থেকে যায় মুঘল যুগের বিভিন্ন তথ্য ও পঞ্চদশ শতকের বিখ্যাত কবি বিপ্রদাস এর লেখায় স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় যে কলকাতার প্রাচীন নাম ছিল কলিকাতা। কলকাতা শহরের নাম কিভাবে তা নিয়ে নানা মতবাদ রয়েছে তার মধ্যে যেটি সর্বজনগ্রাহ্য তাতে বলা হয় হিন্দু দেবী কালীর নাম থেকে কলিকাতা নামটি উদ্ভাবির, যার প্রকৃত নাম ছিল কালী ক্ষেত্র অর্থাৎ দেবী কালীর স্থান তারপর ক্রমে কলিকাতা নামটি আসে।
এই ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি মতামত জনপ্রিয় যেমন কেউ কেউ বলেন এই শহরের জনবসতি গড়ে উঠেছিল খালের ধারে তা থেকে নামটি এসেছে আবার আরো একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যেখানে বলা হয় ব্রিটিশরা যখন এই শহরে এসেছিলেন তখন তারা গোলায় নর কঙ্কাল এর মালা দেওয়া দেবীকে দেখেন সেই থেকে পরে কলিকাতা নামটি আসে।
এরকম আরো নানান তথ্য রয়েছে কলিকাতা নামের সৃষ্টি নিয়ে কিন্তু তার মধ্যে কোনটি সঠিক তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।
আরো পড়ুন – কলকাতার কিছু বিখ্যাত মন্দির
ভালো লাগলে পোস্টটি সকলের সাথে অবশ্যই শেয়ার করুন | আপনাদের মতামত নিচে কমেন্ট করে অবশ্যই জানান আমরা অপেক্ষায় আছি |
নিচের ভিডিওটি দেখুন