November 20, 2024

এই ভারতেই আছে এমন কিছু গ্রাম, যেখানে সবাই কথাবলে সংস্কৃত ভাষায়

sanskrit speaking village

   সংস্কৃত ভাষা হল একটি ঐতিহ্যবাহী হিন্দু ভাষা। দীর্ঘ সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে নিজের ইতিহাস গড়ে তুলছে। এই ভাষায় লিখিত লিপি গুলিকে বলা হয় দেবনাগরী‘, যার অর্থ ভগবানের রাজ্য। তাই সংস্কৃত ভাষাকে ‘দেবভাষা’ ও বলা হয় । সংস্কৃত কথাটির উৎপত্তি হয়েছে দুটি শব্দ থেকে, “সাম” অর্থাৎ ‘সমগ্র’ ও “কৃত”  অর্থাৎ ‘সমাপ্ত’ । তাহলে সংস্কৃত শব্দের  অর্থ হল সম্পূর্ণভাবে বা নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করা। প্রাচীনকালে শুধুমাত্র মুখে বলা ও শোনার মাধ্যমে এই ভাষা চর্চিত হতো, কিন্তু পরবর্তীকালে পড়া ও শোনার সাথে লিখিত ভাবেও এই ভাষা বহুল প্রচলিত হয়।

কিন্তু ধীরে ধীরে এই ভাষা তার জায়গা হারায়, যুগের পরিবর্তনে মানুষ আধুনিক হতে থাকে এবং তুলনামূলক এই শক্ত ভাষাটি এখন শুধুমাত্র ধার্মিক অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণদের মন্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালঅয়ে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা এখনো এই ভাষার চর্চা করলেও তা খুবই সীমিত। ইতিহাসের প্রাচীন ও মধ্যযুগের বহুল চর্চিত এই ভাষা এখন বিলুপ্তপ্রায়। কিন্তু এখনো আমাদের ভারতে এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে ভারতীয় সংস্কৃতির এই ধারাকে বজায় রাখার জন্য এখনও শিশু থেকে বৃদ্ধ , সবাই সর্বত্র  ও সর্বক্ষণ এই ভাষাতেই কথা বলে। আসুন জেনেনি এদের কথা।

১) মাত্তুর, কর্নাটক (Mattur, Karnataka)

সংস্কৃত ভাষা ব্যবহারের প্রাচুর্যতায় যে গ্রামটির নাম সর্বাগ্রে উঠে আসে তা হলো কর্নাটকের মাত্তুর নামে একটি ছোট্ট গ্রাম। ব্যাঙ্গালোরের মতো অত্যাধুনিক শহর থেকে মাত্র ৩০০ কিলোমিটার দূরত্বে,  তুঙ্গা নদীর তীরে বসবাসরত এই মানুষগুলোর মাঝে গেলে মনে হবে, আপনি পা রেখেছেন ২০০০ বছরের পুরনো ভারতে । এখানকার মানুষজন এখনো বৈদিক জীবনযাত্রা পালন করেন। তাদের পরনে থাক,  দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণদের ট্রাডিশনাল পোশাক, পাত্তুভেস্তি অর্থাৎ ধুতি ও অঙ্গবস্ত্রম অর্থাৎ উড়নি, উভয়ই হয় রঙিন বর্ডার দেওয়া সাদা রঙের।

এই গ্রামে সংস্কৃত ভাষা ব্যবহারের একটি সুন্দর ইতিহাস আছে । এই গ্রামটিতে যারা বাস করেন, তারা মূলত সাংকেথী  ব্রাহ্মণ । প্রায় ৬০০ বছর আগে বিজয়নগর সাম্রাজ্যকালীন সময়ে, রাজপরিবার থেকে এই গ্রামট্‌ কেরালা থেকে আগত সাংকেথী ব্রাহ্মণদের উপহার দেওয়া হয়। তখন থেকেই এটি  তাদের গ্রাম । তাই এখনো অধিকাংশ জনগণ  এই প্রজাতিভুক্ত।

১৯৮০সাল পর্যন্ত এখানকার মানুষেরা কথ্য ভাষা হিসেবে এখানকার অফিশিয়াল ভাষা  কন্নড় ব্যবহার করলেও, পরে এক আঞ্চলিক গুরুর আহ্বানে, ভারতের সংস্কৃতিকে ধরে রাখার তাড়ণায়, পৃথিবীর অন্যতম পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী ভাষাকে এখানকার কথ্য ভাষা হিসেবে প্রচলন করার প্রচেষ্টা শুরু হয় এবং আশ্চর্যজনকভাবে, মাত্র ১০ দিন, মাত্র দু’ঘণ্টা করে সময় অতিবাহিত করে, সমস্ত গ্রামের মানুষ এভাষা রপ্ত করাতে  সক্ষম হয় । তখন থেকে আজ পর্যন্ত এখানকার মানুষেরা, প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ভাষাকে আত্মস্থ করে আসছেন। এই গ্রামের পরিবেশও অন্যরকম, শান্ত, স্নিগ্ধ। দেখা যায় দক্ষিণ ভারতের ট্রেডিশনাল ধাচের বাড়ি, যার দরজা এখনো বিশ্বাসের জোরে সর্বদা খোলা থাকে। অতিথিদের স্বাগত জানানো হয় সাদরে, কারণ তাদের কাছে  অতিথি মানে ভগবান।  শুনলে অবাক হবেন, এই গ্রামে থাকার কোন হোটেল নেই। বাইরে থেকে কোন পর্যটক এলে, তারা থাকেন এখানকার সাধারণ মানুষের বাড়িতেই। যত্ন সহকারে তাদের আহারের ব্যবস্থা করেন সেই গৃহের সদস্যরা।

আরও জানুনভারতের গভীরতম ও বৃহত্তম মেট্রো স্টেশন

 তবে ভাববেন না, এখানকার মানুষেরা উন্নত জগতের সাথে পরিচিত নয়। এখানে যেমন হাই স্কুল রয়েছে, তেমনি রয়েছে খোলা আকাশের নিচে পাঠশালা, এখানকার ছাত্র-ছাত্রীরা যেমন ইংরেজি , ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তেমনি আবার সংস্কৃত শ্লোকও খুব সহজে বলতে পারে। ধুতি পরে ফুটবল খেলতেও তাদের জুড়ি মেলা ভার ।

এখানকার এক শিক্ষকের মতে, সংস্কৃত ভাষা মানুষকে প্রাচীন ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ শেখায়, বহুভাষার আঁধার এই ভাষা।  ইংরেজি , জার্মানি,  কানাড়া ইত্যাদি নানা ভাষার নানা শব্দের উৎস এই  সংস্কৃত ভাষা। এই ভাষার সৌন্দর্য কে হারাতে না দেওয়া এবং আমাদের পরম্পরাকে ধরে রাখাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য এবং তারা খুশি যে, বর্তমান প্রজন্মরা এই ভাষা সম্বন্ধে আগ্রহ নিয়ে তাদের কাছে শিখতে আসে।  শুধু এই গ্রাম নয় আশেপাশের গ্রাম ও দূরদূরান্ত থেকেও ছাত্রছাত্রীরা তাদের গ্রামে আসে সংস্কৃত শিখতে। তাদের গ্রামে বহু ছেলেমেয়ে দেশ-বিদেশে চাকরি সূত্রে রয়েছে, কিন্তু তিনি খুশি যে, তারা তাদের উৎস কে ভুলে যায়নি। তাই ছুটিতে এলেও তাদের মুখে শোনা যায় সংস্কৃত ভাষা, আর তা নিয়ে তারা গর্বিত।

 সত্যিই, কত বিচিত্র আমাদের দেশ। তাই সুযোগ হলে ভারতের এই বিচিত্র গ্রামটিতে, একবার হলেও যাবেন ।

• আর কি কি দেখার আছে ?

 এই ছোট্ট গ্রামটিতে রয়েছে সাতটি মন্দির । এর মধ্যে তিনটি হল- কেশব, শ্রী রাম এবং লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দির, এই তিনটি মন্দিরে পূজিত হন বিষ্ণু দেবতা। আরও তিনটি হল ত্রয়ামবাকেস্বরা, গৌরী শঙ্কর ও সোমেশ্বর মন্দির, এই মন্দিরগুলি মহাদেবের উদ্দেশ্যে। আরো একটি হলো হনুমান মন্দির। এছাড়াও রয়েছে গুরুকুল প্রাচীন ভারতের মতোই জুত খুলে প্রবেশ করতে হয় এখানে । মাদুরে বসে চলে সংস্কৃত শিক্ষা, আর রয়েছে সংস্কৃত পুস্তক এর লাইব্রেরী। আর প্রকৃতি ভালোবাসলে, অবশ্যই যাবেন তুঙ্গা নদী তীরে । এছাড়াও রয়েছে একটি ইক্কেড়ি ও কেলাড়ি নামে দুটি জায়গা যেখানে দেখা যায় কেলাদি রাজাদের  ধ্বংসাবশেষ ।

• কিভাবে যাবেন ?

বেঙ্গালুরু থেকে গাড়ি অথবা ট্রেনে আপনাকে যেতে হবে শিবমজ্ঞা(shavamogga) সেখান থেকে গাড়ি বুক করে আপনি এই গ্রামে যেতে পারবেন।

 

এই গ্রামটি ছাড়াও ভারতবর্ষে এখনো আরো কিছু গ্রাম আছে যেখানে এখনো সংস্কৃত ভাষাতে কথাবার্তা চলে।

২) ঝিরি, মধ্যপ্রদেশ (Jhiri, Madhya Pradesh)

মধ্যপ্রদেশের রাজগড় জেলার সারাংপুর তহসিলের একটি ছোট্ট পল্লী হলো ঝিরি। যেখানকার জনসংখ্যা হাজার জনেরও কম। ইন্দোরের মত বড় শহর থেকে মাত্র দেড়শ কিলোমিটার দূরের এই গ্রামের ছেলে, মেয়ে, বৃদ্ধ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সমস্ত মানুষের মুখে একটিই ভাষা, সংস্কৃত। এখানকার আঞ্চলিক ভাষা হল মালবি(Malwi)। সেই ভাষায় বর্তমানে কাউকে কথা বলতে শোনা যায়না। “সমস্কৃত ভারতী” নামে একটি সংস্থা বিমলা তিওয়ারি নামক এক মহিলার নেতৃত্বে সমস্কৃত সম্ভাষণ ক্যাম্পের মাধ্যমে মাত্র এক বছরের মধ্যে সমস্ত গ্রামের মানুষের মধ্যে এই ভাষার প্রতি আগ্রহ সঞ্চার করেনএবং তখন থেকে আজ প্রায় ষোল বছর ধরে সেখানকার প্রচলিত কথ্য ভাষা সংস্কৃত।

৩) বাঘুওয়ার, মধ্যপ্রদেশ (Baghuwar, Madhya Pradesh)

এই গ্রামটি মধ্যপ্রদেশের করেলি তহসিলের অন্তর্গত নরসিংহপুর জেলা সদর থেকে মাত্র 15 কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। একশো শতাংশ সাক্ষরতার হার যুক্ত এই গ্রামটির মুখ্য ভাষা সংস্কৃত। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এই ভাষাতে বেশ পটু।

৪) মোহাদ, মধ্যপ্রদেশ (Mohad, Madhya Pradesh)

মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুর জেলার একটি গ্রাম পঞ্চায়েত, মোহাদ, খাড়গণ জেলা সদর থেকে মাত্র 25 কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। মাত্র 883 টি বাড়িযুক্ত এই গ্রামটির নিকটস্থ শহর শাহপুর, যা  প্রায় 11 কিলোমিটার দূরে। এই গ্রামটিতে সমস্ত গ্রামবাসীর সংস্কৃত ভাষায় কথোপকথন শুনে অবাক হতে হয়।

৫) গানোড়া, রাজস্থান (Ganoda, Rajasthan)

রাজস্থানের বানস্বরা জেলার এই গ্রামে কয়েক বছর আগে পর্যন্তও ওয়াগাদি ভাষায় কথা বলা হতো। কিন্তু কয়েক বছর আগে এখানে একটি সংস্কৃত ভাষার প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়, যেখানে প্রাথমিক স্তর থেকে কলেজের স্তর পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হয় এবং এখানকার শিক্ষক সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের সংস্কৃত ভাষায় পোক্ত করার জন্য সর্বদা এই ভাষায় কথা বলার জন্য উৎসাহিত করেন। এইভাবে ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের থেকে তাদের গৃহের অন্যান্যরা এই ভাষা রপ্ত করে নেন এবং বর্তমানে এই ভাষাই তাদের কথ্য ভাষা।

৬) হোসাহাল্লি,কর্ণাটক (Hosahalli )

কর্ণাটকের মাত্তুরের মত তুঙ্গা নদীর তীরের আরও একটি গ্রাম হল হোসাহাল্লি। এখানেও বয়স নির্বিশেষে সবাই যেকোনো ধরনের কথোপকথনের জন্য সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করেন। সংস্কৃত ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার এই উদ্যোগের আরও একটি কারণ হল এখানকার বিখ্যাত গামাকা শিল্পকলাকে বাঁচিয়ে রাখা,যার মাধ্যমে কর্ণাটকি সংগীতের সাথে সাথে নানান গল্প কথা বলা হয়।

৭)সাসানা, ওড়িশা (Sasana, Odisha)

ওড়িশার উপকূল অঞ্চলে অবস্থিত গজপতি জেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রাম সাসানা। এখানকার অধিকাংশ মানুষই ব্রাহ্মণ এবং তাদের মধ্যে অনেকেই সংস্কৃত ভাষার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এখানকার প্রায় পঞ্চাশটি বাড়ির প্রত্যেকটিতেই অন্তত একজন করে সংস্কৃত পণ্ডিত রয়েছেন, যার প্রভাব বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের কথোপকথনেও স্পষ্ট বোঝা যায়।

ভালো লাগলে পোস্টটি সকলের সাথে অবশ্যই শেয়ার করুন । আপনাদের মতামত নিচে কমেন্ট করে অবশ্যই জানান আমরা অপেক্ষায় আছি ।

নিচের ভিডিওটি দেখুন

Facebook Comments Box
BengaliEnglishHindi